তাক্বদীরের স্তরসমূহ - প্রথম স্তর: সবকিছু সম্পর্কে আল্লাহ্‌র চিরন্তন জ্ঞানের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন

তাক্বদীরের স্তর চারটি। মূলতঃ এই চারটি স্তরের উপর তাক্বদীরের ভিত্তি সুপ্রতিষ্ঠিত বলে অনেকেই এগুলিকে তাক্বদীরের রুকন বা স্তম্ভ হিসাবে আখ্যা দিয়েছেন।[1]

এগুলিকে আবার তাক্বদীর উপলব্ধির প্রবেশদ্বারও বলা হয়। সেজন্য প্রত্যেক মুসলিমের এ চারটি স্তর সম্পর্কে অন্ততঃ প্রাথমিক জ্ঞানটুকু থাকা অতীব যরূরী। এগুলির একটি আরেকটির সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। যে ব্যক্তি এই চারটি স্তরের প্রত্যেকটি জানবে এবং বিশ্বাস করবে, তাক্বদীরের প্রতি তার ঈমান পূর্ণতা লাভ করবে। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি এই চারটির কোন একটি বা একাধিক অমান্য করবে, তাক্বদীরের প্রতি তার ঈমান ত্রুটিপূর্ণ থেকে যাবে।[2]

ইমাম ইবনুল ক্বাইয়িম (রহেমাহুল্লাহ) বলেন, ‘যে ব্যক্তি এই চারটি স্তরে বিশ্বাসী নয়, সে মূলতঃ তাক্বদীরকেই বিশ্বাস করে না’।[3]  নিম্নে উক্ত চারটি স্তরের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা তুলে ধরা হলঃ

প্রথম স্তর: সবকিছু সম্পর্কে আল্লাহ্‌র চিরন্তন জ্ঞানের প্রতি বিশ্বাস স্থাপনঃ

একথার অর্থ হচ্ছে, সবকিছু সম্পর্কে আল্লাহ্‌র পরিপূর্ণ জ্ঞান আছে এমর্মে আমাদেরকে দৃঢ় বিশ্বাস করতে হবে। যা কিছু ঘটেছে এবং যা কিছু ঘটবে, সে সম্পর্কে তিনি জানেন। আর যা ঘটেনি, তা যদি ঘটত, তাহলে কিভাবে ঘটত, তাও তিনি জানেন। সৃষ্টির ভাল-মন্দ, আনুগত্য-অবাধ্যতা ইত্যাদি সার্বিক কার্যকলাপ সম্পর্কে তিনি খবর রাখেন। তাদের যাবতীয় অবস্থা, হায়াত-মউত, আয়ূস্কাল, রিযিক্ব, নড়াচড়া, স্থির থাকা ইত্যাদি বিষয়ে তিনি সম্যক অবগত। তাদের মধ্যে কে দুর্ভাগা ও কে সৌভাগ্যবান হবে, বরযখী জীবনে তাদের ভাগ্যে কি ঘটবে, পুনরুত্থানের পরে তাদের কি হবে ইত্যাদি সব বিষয়েই তিনি চিরন্তন জ্ঞানের অধিকারী।[4]

ইবনে তায়মিইয়াহ (রহেমাহুল্লাহ) বলেন, ‘আমাদেরকে এ বিশ্বাস করতে হবে যে, সৃষ্টিজীব কি করবে, সে বিষয়ে আল্লাহ তাঁর চিরন্তন জ্ঞানের মাধ্যমে চিরস্থায়ীভাবে সম্যক অবগত। তিনি তাদের সৎকাজ, পাপকাজ, রিযিক্ব, আয়ূসহ সার্বিক অবস্থা সম্পর্কে ওয়াক্বিফহাল’।[5]

উছমান ইবনে সাঈদ (রহেমাহুল্লাহ) বলেন, ‘আমাদেরকে অবশ্যই বিশ্বাস করতে হবে যে, সৃষ্টি জীবকে সৃষ্টির আগে থেকেই আল্লাহ তাদের সম্পর্কে ও তাদের আমল সম্পর্কে জ্ঞাত হয়ে আসছেন এবং ভবিষ্যতেও জ্ঞাত থাকবেন। সৃষ্টি জগতকে সৃষ্টির ক্ষেত্রে তাঁর চিরন্তন জ্ঞানের সাথে একটি সরিষার দানা পরিমাণও যোগ হয় নি’।[6]

মহান আল্লাহ বলেন,

 ﴿وَعِندَهُ مَفَاتِحُ الْغَيْبِ لَا يَعْلَمُهَا إِلَّا هُوَ ۚ وَيَعْلَمُ مَا فِي الْبَرِّ وَالْبَحْرِ ۚ وَمَا تَسْقُطُ مِن وَرَقَةٍ إِلَّا يَعْلَمُهَا وَلَا حَبَّةٍ فِي ظُلُمَاتِ الْأَرْضِ وَلَا رَطْبٍ وَلَا يَابِسٍ إِلَّا فِي كِتَابٍ مُّبِينٍ﴾ [سورة الأنعام: 59]

‘তাঁর কাছেই গায়েবী বিষয়ের চাবিসমূহ রয়েছে; এগুলি তিনি ব্যতীত কেউ জানে না। স্থলে ও জলে যা কিছু আছে, তিনিই জানেন। তাঁর জানার বাইরে (গাছের) কোন পাতাও ঝরে না। তাক্বদীরের লিখন ব্যতীত কোন শস্যকণা মৃত্তিকার অন্ধকার অংশে পতিত হয় না এবং কোন আর্দ্র ও শুষ্ক দ্রব্যও পতিত হয় না’ (আন‘আম ৫৯)।

অন্যত্রে তিনি বলেন,

﴿إِنَّ اللَّهَ عِندَهُ عِلْمُ السَّاعَةِ وَيُنَزِّلُ الْغَيْثَ وَيَعْلَمُ مَا فِي الْأَرْحَامِ ۖ وَمَا تَدْرِي نَفْسٌ مَّاذَا تَكْسِبُ غَدًا ۖ وَمَا تَدْرِي نَفْسٌ بِأَيِّ أَرْضٍ تَمُوتُ ۚ إِنَّ اللَّهَ عَلِيمٌ خَبِيرٌ﴾ [سورة لقمان: 34]

‘নিশ্চয় আল্লাহ্‌র কাছেই ক্বিয়ামতের জ্ঞান রয়েছে। তিনিই বৃষ্টি বর্ষণ করেন এবং গর্ভাশয়ে যা থাকে, তিনি তা জানেন। কেউ জানে না আগামীকাল সে কি উপার্জন করবে এবং কেউ জানে না কোথায় সে মৃত্যুবরণ করবে। আল্লাহ সর্বজ্ঞ, সর্ববিষয়ে সম্যক জ্ঞাত’ (লুক্বমান ৩৪)।

মহান আল্লাহ আরও বলেন,

﴿عَلِمَ أَن سَيَكُونُ مِنكُم مَّرْضَىٰ ۙ وَآخَرُونَ يَضْرِبُونَ فِي الْأَرْضِ يَبْتَغُونَ مِن فَضْلِ اللَّهِ ۙ وَآخَرُونَ يُقَاتِلُونَ فِي سَبِيلِ اللَّهِ﴾ [سورة المزمل: 20]  

‘তিনি জানেন, তোমাদের মধ্যে কেউ কেউ অসুস্থ হবে, কেউ কেউ আল্লাহর অনুগ্রহ সন্ধানে যমীনে বিচরণ করবে এবং কেউ কেউ আল্লাহর পথে জিহাদে লিপ্ত হবে’ (মুয্‌যাম্মেল ২০)।

 অন্যত্র আল্লাহ বলেন,

﴿هُوَ اللَّهُ الَّذِي لَا إِلَٰهَ إِلَّا هُوَ ۖ عَالِمُ الْغَيْبِ وَالشَّهَادَةِ﴾ [سورة الحشر: 22]

‘তিনিই হচ্ছেন আল্লাহ, যিনি ব্যতীত আর কোন উপাস্য নেই। তিনি অদৃশ্য এবং দৃশ্য সম্পর্কে সম্যক অবগত’ (হাশর ২২)।

হাদীছে এসেছে, রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) কে যখন মুশরিকদের ছেলে-মেয়ে সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, তখন তিনি বলেছিলেন, ‘তারা বেঁচে থাকলে কি আমল করত, সে সম্পর্কে আল্লাহ সম্যক অবগত’।[7]

ইমরান ইবনে হুছাইন (রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু) বলেন, এক ব্যক্তি রাসুল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) কে জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহ্‌র রাসূল! কে জান্নাতী আর কে জাহান্নামী তা কি পরিজ্ঞাত বিষয়? তিনি বললেন, ‘হ্যাঁ’। লোকটি বললেন, তাহলে মানুষ কেন আমল করবে? তিনি বললেন,

 «كُلٌّ يَعْمَلُ لِمَا خُلِقَ لَهُ أَوْ لِمَا يُيَسِّرُ لَهُ»

‘যাকে যেজন্য সৃষ্টি করা হয়েছে বা যার জন্য যা সহজ করা হয়েছে, সে তা-ই করবে’।[8] এরকম অসংখ্য আয়াত এবং হাদীছ রয়েছে, যেগুলি সর্ব বিষয়ে মহান আল্লাহ্‌র চিরন্তন জ্ঞানের প্রমাণ বহন করে।

[1]. দেখুন: ড. ওমর সুলায়মান আশক্বার, আল-ক্বাযা ওয়াল-ক্বাদার, (কুয়েত: মাকতাবাতুল ফালাহ, দ্বিতীয় প্রকাশ: ১৯৯০ইং), পৃ: ২৯-৩৬; আল-ঈমান বিল-ক্বাযা ওয়াল ক্বাদার/৫৯ ইত্যাদি।

[2]. আল-ঈমান বিল-ক্বাযা ওয়াল ক্বাদার/৫৯।

[3]. ইবনুল ক্বাইয়িম (রহেমাহুল্লাহ), শিফাউল আলীল ফী মাসাইলিল ক্বাযা ওয়াল ক্বাদার ওয়াল হিকমাতি ওয়াত্‌-তা‘লীল, (বৈরূতঃ দারুল কুতুবিল ইলমিইয়াহ, তৃতীয় প্রকাশ: তা.বি), পৃ: ৫৫।

[4]. ফালাহ ইবনে ইসমাঈল, আল-ই‘তিক্বাদুল ওয়াজিব নাহ্‌ওয়াল ক্বাদার/৯।

[5]. মাজমূ‘উ ফাতাওয়া ইবনে তায়মিইয়াহ, ৩/১৪৮।

[6]. ইমাম দারেমী, আর-রাদ্দু আলাল-জাহমিইয়াহ, তাহক্বীক্ব: বদর ইবনে আব্দুল্লাহ আল-বাদ্‌র (কুয়েত: আদ-দারুস সালাফিইয়াহ, প্রথম প্রকাশ: ১৯৮৫ইং), ‘আল্লাহ্‌র ইলমের বিবরণ’ অনুচ্ছেদ, পৃ: ১১২।

[7]. ছহীহ মুসলিম, হা/২৬৫৮, ‘তাক্বদীর’ অধ্যায়, ‘মুসলিম এবং কাফেরদের ছোট বাচ্চারা মারা গেলে তাদের কি হুকুম’ অনুচ্ছেদ।

[8]. ছহীহ বুখারী, ৪/২০৯, হা/৬৫৯৬, ‘তাক্বদীর’ অধ্যায়, ‘কলম শুকিয়ে গেছে..’ অনুচ্ছেদ, (মিশর: আল-মাকতাবাহ আস-সালাফিইয়াহ, প্রথম প্রকাশ: ১৪০০হিঃ)।